হাঁড়ি-কড়াই থেকেই স্বপ্নপূরণ: ‘কাঁঠাল চিপস কারিগর’ রুপা খাতুনের গল্প
নিজস্ব প্রতিবেদক:
স্কুলজীবনের গণ্ডি পেরিয়ে অষ্টম শ্রেণিতে উঠেছিলেন মাত্রই— সময়টা ১৯৯৬ সাল। স্বপ্ন ছিল বই-খাতা হাতে বড় হওয়ার, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। কিন্তু বয়স যখন আনন্দে মাতিয়ে তোলার, তখনই জীবনে নেমে আসে বড় এক বাঁক। পরিবার হঠাৎ করেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। আর সেই সিদ্ধান্তেই থেমে যায় শিক্ষাজীবন, ভেঙে যায় এক কিশোরীর ভবিষ্যতের স্বপ্ন।
তবে স্বপ্ন দেখা থেমে থাকেনি। আজ সেই কিশোরী রুপা খাতুন— যিনি এখন পরিচিত ‘কাঁঠাল চিপস কারিগর’ হিসেবে। যশোরের সদর উপজেলার লেবুতলা ইউনিয়নের কোদালিয়া গ্রামের এই নারী নিজ বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন ‘রেইনবো অ্যাগ্রো ফুড’ নামের একটি ক্ষুদ্র খাদ্যপ্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠান। এখান থেকেই তৈরি করছেন কাঁঠালের চিপসসহ নানা ধরনের ঘরোয়া খাদ্যপণ্য।
অজপাড়াগাঁ থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার পথচলা
রুপা খাতুনের বাবার বাড়ি মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার পুশখালি গ্রামে। বাবা শামসুর রহমান বিশ্বাস পেশায় ছিলেন কাঠ ব্যবসায়ী। ১৯৯৬ সালে মাত্র সপ্তম শ্রেণি পাস করে অষ্টম শ্রেণিতে উঠতেই হঠাৎ করেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় রুপাকে। তার স্বামী ইখতার আলী যশোর সদর উপজেলার কোদালিয়া গ্রামের বাসিন্দা, পেশায় কাপড়ের ব্যবসায়ী।
গৃহিণীর ভূমিকা পালনের পাশাপাশি রুপা খুঁজছিলেন আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পথ। প্রথমে রান্নার কাজে পারদর্শিতা দিয়েই শুরু করেন আচার, বড়ি, জ্যাম, জেলি, পাটালি ইত্যাদি তৈরির কাজ। ধীরে ধীরে নিজের হাতে গড়া পণ্য স্থানীয় বাজারে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর চলতি বছর থেকে শুরু করেছেন কাঁঠালের চিপস তৈরি— যা স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে এখন অনলাইনের মাধ্যমেও বিক্রি হচ্ছে।
প্রতিমাসে তিনি কাঁঠালের চিপস বিক্রি করে আয় করছেন প্রায় ২০ হাজার টাকা। রুপা জানান, “কাঁঠাল আমাদের গ্রামের সিজনাল ফল হলেও এর পুরোটা ব্যবহার হয় না। আমি ভাবলাম— কীভাবে এই কাঁঠালকে দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণ ও রুচিকর পণ্যে রূপান্তর করা যায়। তখনই মাথায় আসে কাঁঠাল চিপসের কথা।”
সমালোচকদের প্রশংসায় রূপান্তর
রুপার ভাষায়, “শুরুর দিকে অনেকে হাসতেন, সমালোচনা করতেন। বলতেন— এসব দিয়ে কী হবে? এখন তারাই এসে দেখেন কীভাবে কাজ করছি, পরামর্শ চান কীভাবে শুরু করতে হয়।”
এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে অক্লান্ত পরিশ্রম, আত্মবিশ্বাস এবং পরিবার ও গ্রামের নারীদের মাঝে সম্ভাবনা দেখার ক্ষমতা। বর্তমানে রুপা খাতুন নিজের প্রতিষ্ঠানে কয়েকজন নারীকেও প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, যারা ভবিষ্যতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চান।
নারী উদ্যোক্তাদের অনুপ্রেরণা
আজকের রুপা খাতুন শুধুমাত্র নিজের ভাগ্য বদলাননি, হয়ে উঠেছেন অন্য নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার নাম। অল্প পুঁজি, সীমিত সুযোগ— কিছুই তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। হাঁড়ি-কড়াইয়ের ঘ্রাণে মিশেছে সাহস আর স্বপ্নের সুবাস। আর সেখান থেকেই উঠে এসেছে নতুন এক সম্ভাবনার গল্প।
মন্তব্য করুন