১৬ বছর আগে পিলখানায় সংঘটিত বিডিআর হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে নতুন করে নানা তথ্য সামনে এনেছে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন। রোববার (৩০ নভেম্বর) প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর এক সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান দাবি করেন—ঘটনাটি ছিল ‘দীর্ঘ সময় ধরে পরিকল্পিত’ এবং এতে ‘ভারতসহ বহিঃশক্তির যোগসাজশের প্রমাণ’ পাওয়া গেছে।
‘বাহিনী দুর্বল করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করার চেষ্টা’
ফজলুর রহমানের বক্তব্যে উঠে আসে, তদন্তে দেখা গেছে—বিডিআরকে দুর্বল করা এবং বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র হয়েছিল। তার ভাষায়,
“বাহিনীকে দুর্বল করা ও বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনা ছিল; সেই সময় ভারতও এই পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে আগ্রহী ছিল।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, তৎকালীন সরকারের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার উদ্দেশ্যে ঘটনাটি ব্যবহারের চেষ্টা হয়েছিল বলেও নানা সাক্ষ্যে উঠে এসেছে।
রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ
সংবাদ সম্মেলনে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্তে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামরিক নেতার নাম এসেছে। তার দাবি অনুযায়ী, সাক্ষ্য ও নথিপত্র বিশ্লেষণে
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, শেখ সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা জেনারেল তারেক সিদ্দিকী, সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ এবং ডিজিএফআই-এর সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আকবরের নাম উল্লেখযোগ্যভাবে উঠে আসে।
ফজলুর রহমান আরও বলেন, বিদ্রোহের পর দ্রুত পদক্ষেপ নিলে ভারতীয় হস্তক্ষেপের ঝুঁকি ছিল—এমন মন্তব্য তৎকালীন সেনাপ্রধান করেছিলেন বলেও কয়েকটি সাক্ষ্যে উল্লেখ রয়েছে।
ভারতীয় নাগরিকদের উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন
তদন্তে পাওয়া তথ্য উল্লেখ করে কমিশনের প্রধান জানান, ঘটনার সময় প্রায় ৯২১ জন ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং তাদের মধ্যে ৬৭ জনের গতিবিধির কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। তিনি এটিকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে মন্তব্য করেন এবং বহিঃশক্তির সম্পৃক্ততার প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
‘২০০৮ সাল থেকেই পরিকল্পনা শুরু’
কমিশনের দাবি, হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা নির্বাচনের আগের বছর—২০০৮ সাল থেকেই শুরু হয়েছিল। তাদের ভাষায়, বিভিন্ন সময় গোপন বৈঠক হয়েছে এবং এর চূড়ান্ত বাস্তবায়ন ঘটে ২০০৯ সালের বিডিআর বার্ষিক দরবারের দিনে।
বিদ্রোহের অভ্যন্তরীণ কারণ
বিডিআরের ভেতরের ক্ষোভ ও অসন্তোষ নিয়েও কমিশন মত দিয়েছে।
তদন্ত অনুযায়ী,
ডাল–ভাত কর্মসূচি,
অতিরিক্ত ডিউটি,
অফিসারদের প্রতি ক্ষোভ,
অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন
ইত্যাদি অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে বিদ্রোহ ঘটানো হয়।
তাপসকে হত্যা প্রচেষ্টা মামলার সেনা কর্মকর্তা গুমের অভিযোগ নিয়ে মন্তব্য
সাবেক মেয়র তাপসের ওপর হামলার মামলায় পাঁচ সেনা কর্মকর্তাকে ‘গুম’ করা হয়েছিল—এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে কমিশন জানায়, তারা ‘গুম’ হননি; বরং ডিজিএফআইসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল।
প্রতিবেদনের মূল বিষয়
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় পরে একটি বিজ্ঞপ্তিতে জানায়—তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে:
পিলখানা হত্যাকাণ্ড ছিল পরিকল্পিত,
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সবুজ সংকেত ছিল,
আওয়ামী লীগ দল হিসেবে ভূমিকা রেখেছিল,
এবং ঘটনাটির প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন শেখ ফজলে নূর তাপস।
এ ছাড়া বহিঃশক্তির সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
তদন্ত প্রক্রিয়া
কমিশন মোট ২৪৭ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে নিহতদের স্বজন, রাজনীতিক, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, পুলিশ সদস্য, সাবেক ও বর্তমান বিডিআর–বিজিবি সদস্য, কারাবন্দী ব্যক্তি ও সাংবাদিক রয়েছেন।
সাক্ষ্য নিয়েছেন বর্তমান সেনাপ্রধানেরও।
প্রেক্ষাপট
২০০৯ সালের ২৫–২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিদ্রোহে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন, যা দেশের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ হিসেবে বিবেচিত।
মন্তব্য করুন