২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা হারানোর পর নতুন সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও দেশের আদালত ব্যবস্থা কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করছে—তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনো বিচারকরা নানা ধরনের ভয় ও চাপে সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন, যার ফলে বিচার ব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন বাস্তবায়িত হয়নি।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও মানবাধিকার সংস্থা ‘এইচআরপিবি’র প্রেসিডেন্ট মনজিল মোরসেদ জানান, বিচারকরা এখন বিভিন্ন বিষয়ে রায় দিতে ভয় পাচ্ছেন। কারণ, কোনো রায় বা আদেশ দেওয়ার পর যদি তা কোনো গোষ্ঠীর বিরোধিতার মুখে পড়ে, তাহলে বিচারক নিজেই বিপদের মুখে পড়তে পারেন। তিনি বলেন, “আগে রাজনৈতিক মামলা বা সরকারের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কিছুটা ভয় কাজ করত, এখন সেটা প্রায় সবক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে।”
এ বি এম খায়রুল হকের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, একটি রায়ের কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এমনকি জেলেও পাঠানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলা মিথ্যা হওয়া সত্ত্বেও নিম্ন আদালতের বিচারকরা জামিন দিতে সাহস পাননি।
প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেনও বিচার বিভাগের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বিচারকরা এখন আর শুধু রাজনৈতিক চাপ নয়, মব সন্ত্রাস ও সামাজিক প্রচারের ভয়েও ভীত। “একটা গোষ্ঠী যদি কোনো রায়ের বিরোধিতা করে আওয়াজ তোলে, তাহলে বিচারপতির পুরো ক্যারিয়ার হুমকির মুখে পড়তে পারে,” বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, বিচার ব্যবস্থায় কাঠামোগত কোনো বড় পরিবর্তন আসেনি, এবং এসব বিষয়ে গণমাধ্যমেও খুব বেশি আলোচনার সুযোগ নেই। “কেন হাইকোর্টের কয়েকজন বিচারককে সরিয়ে দেওয়া হলো—তা আজও স্পষ্ট নয়। এসব প্রশ্ন তোলাও যেন একধরনের নিষিদ্ধ আলোচনা হয়ে গেছে,” বলেন তিনি।
সাংবাদিক কাজী আব্দুল হান্নান যিনি দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে সুপ্রিম কোর্ট বিটে কাজ করছেন, তার মতে, অবসরের পর বিচারকের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক আচরণ বিচার বিভাগের জন্য অশনি সংকেত। উচ্চ আদালত চাইলেই এই ধরনের আটকাদেশের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করতে পারতেন, কিন্তু তারা নীরব থাকায় বিচারপ্রাপ্তির আশা আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা বলেন, “আদেশ দিলে টার্গেট হব—এই ভয় এখন বিচারকদের মধ্যে প্রকট হয়ে উঠেছে। বিচারকদের এই ভীত অবস্থার মধ্যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বজায় রাখা সম্ভব নয়।”
সবমিলিয়ে বলা যায়, গণঅভ্যুত্থানের পর বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে যে আশা সৃষ্টি হয়েছিল, তা এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। বরং বিচারকরা এখন নানাভাবে আতঙ্কিত ও প্রভাবিত বোধ করছেন, যা বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতার পথে বড় বাধা হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
মন্তব্য করুন