সাতক্ষীরায় বুশরা গ্রুপের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ: ভুক্তভোগীদের আহাজারি
চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা লাপাত্তা, ভেঙে পড়েছে গ্রাহকের ভরসা
নিজস্ব প্রতিবেদক
সাতক্ষীরা | ২৮ জুলাই
সাতক্ষীরায় বহুল আলোচিত বুশরা গ্রুপের বিরুদ্ধে কয়েক হাজার গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। গ্রাহকের জমানো আমানতের টাকা আত্মসাৎ করে প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ তিন কর্মকর্তা—চেয়ারম্যান শেখ শরিফুল ইসলাম, নির্বাহী পরিচালক ইকবাল কবির পলাশ এবং পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন—সম্প্রতি গা ঢাকা দিয়েছেন। এতে চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন ভুক্তভোগীরা।
বুশরা গ্রুপের অধীনে রয়েছে ‘বুশরা ইসলামী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’, বুশরা হাসপাতাল, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং পরিবহন প্রতিষ্ঠান এমআর পরিবহনসহ একাধিক ব্যবসা।
ফাঁদ পেতে গরিবের পকেট কাটা
২০০২ সালে সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে বুশরা। শুরুতে ইসলামী মাল্টিপারপাস সোসাইটির ব্যানারে ক্ষুদ্র ঋণ ও মাসিক মুনাফার প্রলোভনে গ্রাহক সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিশ্রুতি ছিল, জমা টাকার বিপরীতে মাসে প্রতি লাখে ২ হাজার টাকা লাভ।
কিন্তু ধীরে ধীরে লাভ কমিয়ে লাখে ১২০০-১৫০০ টাকায় নামিয়ে আনা হয়। শেষ পর্যন্ত লাভ তো নয়ই, মূল টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না অনেক গ্রাহক। ইতিমধ্যে কালিগঞ্জসহ সাতক্ষীরার বিভিন্ন শাখা বন্ধ করে দিয়েছেন কর্মকর্তারা।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের শত শত ভুক্তভোগী
সোমবার (২৮ জুলাই) সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, কালিগঞ্জ উপজেলার নলতা, সোনাটিকারি, পারুলগাছা, চাঁচাইসহ একাধিক এলাকায় বুশরার বিরুদ্ধে ক্ষোভ দানা বেঁধেছে।
…তাদের সবারই একটাই অভিযোগ—“টাকা চাইলেই তালবাহানা, অফিস বন্ধ, ফোন বন্ধ!”
ভাঙল ভরসা, বাড়ল অবিশ্বাস
ভুক্তভোগী সাইফুল ইসলাম বলেন, “জমি কেনার জন্য আমানত রেখেছিলাম ১০ লাখ টাকা। বছর দেড়েক ধরে অফিসে ঘুরছি, এখন তো অফিসই বন্ধ।”
উভাকুড় গ্রামের উদ্ভব চন্দ্র বলেন, “চার লাখ টাকা রেখেছি, অফিসে গেলে অপমান করে বের করে দেয়।”
স্থানীয়দের ভাষ্য, বুশরা গ্রুপের ‘ধর্মীয় ভাবধারায় আবৃত ব্যবসা’ গ্রামের সহজ-সরল মানুষকে মুনাফার লোভে আকৃষ্ট করেছিল। একপর্যায়ে অফিস খুলে জমি বিক্রি, হাসপাতাল, পরিবহন, এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও খুলে ফেলে।
কোটি টাকার সম্পদ, গ্রাহকের টাকায়
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বুশরার এক কর্মকর্তা বলেন, “গ্রাহকের টাকায় চেয়ারম্যান শেখ শরিফুল ইসলাম খুলনা ও সাতক্ষীরায় শত বিঘার ওপর জমি কিনেছেন। নির্বাহী পরিচালক পলাশ এমআর পরিবহন গড়েছেন। আর পরিচালক মামুনের নামে বুশরা হাসপাতালসহ তিনটি বাড়ি রয়েছে।”
তার দাবি, গ্রাহকের টাকায় অর্জিত এসব সম্পদের আনুমানিক মূল্য ৩০–৩৫ কোটি টাকা।
প্রশাসনের নীরবতা ও প্রতিশ্রুতি
বুশরা গ্রুপের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে। সাতক্ষীরা জেলা সমবায় কর্মকর্তা এফএম সেলিম আখতার জানান, “বুশরা আমাদের কাছ থেকে কয়েকটি সমবায় সোসাইটির নিবন্ধন নিয়েছে। কিন্তু অভিযোগ এসেছে, তারা নানা নামে মানুষের কাছ থেকে আমানত নিচ্ছে। প্রাথমিকভাবে সতর্ক করা হয়েছে। প্রয়োজন হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
যোগাযোগের চেষ্টা ব্যর্থ
চেয়ারম্যান শেখ শরিফুল ইসলাম, নির্বাহী পরিচালক পলাশ ও পরিচালক মামুনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা ফোন ধরেননি।
উপসংহার
সাতক্ষীরায় বুশরা গ্রুপের এমন প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের শিকার কয়েক হাজার মানুষ আজ অসহায়। প্রশাসন যদি দ্রুত হস্তক্ষেপ না করে, তবে শুধু টাকা নয়—নষ্ট হবে মানুষের বিশ্বাসও। ভুক্তভোগীদের প্রত্যাশা, সরকারের যথাযথ পদক্ষেপেই ফেরত মিলবে তাঁদের কষ্টার্জিত সঞ্চয়।
মন্তব্য করুন